নেতানিয়াহুর ছেলের বিয়ে, প্রধানমন্ত্রীর ছুটির ঘোষণা—সবই ছিল এক নিখুঁত প্রতারণা। যখন বিশ্ব ভাবছিল উৎসব চলছে, তখনই শুরু হয় ইতিহাসের সবচেয়ে গোপন ও ঘাতক সামরিক অভিযান: অপারেশন "নার্নিয়া" ও "রেড ওয়েডিং"। ইরানের পরমাণু বিজ্ঞানী ও শীর্ষ সেনা কর্মকর্তারা একে একে খুন হচ্ছিলেন—ড্রোন, স্লিপার এজেন্ট আর হ্যাকিংয়ের নিখুঁত সমন্বয়ে। মাত্র চার ঘণ্টায় ভেঙে পড়ে ইরানের প্রতিরক্ষা। কীভাবে এত নিখুঁত ছিল পরিকল্পনা? কীভাবে এক বিয়েকে পরিণত করা হয় যুদ্ধের ঢাল হিসেবে? আজ জানুন সেই অপারেশনের অজানা গল্প—যা ইতিহাসে একে বলা হবে: “বিয়ের আড়ালে রক্তঝরা রাত”।
ইস্রায়েল, একটি ছোট রাষ্ট্র, যার ভূ-রাজনৈতিক ও কৌশলগত অবস্থান ১৯৪৮ সালের প্রতিষ্ঠার পর থেকেই একচ্ছত্রভাবে বিতর্ক ও সংঘর্ষে আবদ্ধ। ইস্রায়েলের স্থিতি প্রায়শই নির্ভর করে তার শক্তিশালী সামরিক সক্ষমতা, গোয়েন্দা তথ্য-নেটওয়ার্ক ও বিশ্বমহল–এর সাথে সম্পর্কের ওপর। আর ইরান? ১৯৭৯-এর ইসলামী বিপ্লবের পর থেকে পশ্চিমা বিশ্ব, বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের জন্য চরম নিরাপত্তার হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিগত কিছু দশকে ইরান উচ্চশক্তির পরমাণু গবেষণা পরিচালনা করছিল যা ইসরায়েলসহ পশ্চিমা বিশ্বের জন্য শর্ট-টার্ম হুমকি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। ২০০০-এর দশকের শুরু থেকে ইসরায়েল আপাতত গোপনে নানা অপারেশন চালিয়ে এসেছে। হয়েছে একের পর এক সাবোটাজ, গুপ্ত হামলা, সফটওয়্যার হ্যাকিং, যাতে ইরানের পরমাণুধারা ধীরভাবে স্থবির হয়েছিল।
কিন্তু ২০২৫ সালের ১২ দিনের যুদ্ধ সব হিসাব-নিকাশ বদলে দিয়েছে। যুদ্ধের একেবারে শুরুতেই ইরানের এক ডজন সেনা কর্মকর্তা আর পরমাণু বিজ্ঞানীকে হত্যা করতে সমর্থ হয় ইস্রায়েল। এর পেছনে ছিল অন্তত ১০ বছরের পরিকল্পনা আর বিশাল গুপ্ত অপারেশন। আজ আমরা জানবো সেই অপারেশনের গল্প I
১৯৯০-এর দশকে ইরানের পরমাণু প্রকল্পে নজর দিতে শুরু করে মোসাদ ও অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থা। তারা ইরানের গবেষণা কেন্দ্রে কখনও মাদক, কখনও বাইসাইকেলের মধ্যে করে বিস্ফোরক ও সাইবার আক্রমণের মাধ্যমে ক্রমাগত বাধা দেয়। কিন্তু এসব চেষ্টা কখনোই পূর্ণতা পায়নি। শেষমেশ, বোঝা যায় যে শুধুমাত্র গোপন অভিযান যথেষ্ট নয় একটি বড় ও দৃশ্যমান আক্রমণ প্রয়োজন, যা রূপ দেওয়া হলো বিমান হামলার মাধ্যমে।তবে বাস্তবে হামলা পরিচালনা করা সহজ ছিল না। প্রথমত, নেতানিয়াহু বারবার নিরাপত্তা পরিষদের সাথে আলোচনায় বাধা পান— কারণ যুদ্ধ শুরু করলে অঞ্চল উত্তপ্ত হয়ে উঠতে পারে, নয়তো আমেরিকার নিষেধাজ্ঞার ঝুঁকি তৈরি হতে পারে। ২০১০-এর দশকে তারা বহুবার বিমান হামলা পরিকল্পনা বন্ধ করে দেয়। আগস্ট ২০১২ ও মার্চ ২০১0 চলাকালীন এ ধরনের প্ল্যান ঘিরে আমেরিকা ও মিত্র দেশের সাথে ইস্রায়েলের মতবিরোধ দেখা দেয়।
২০২৪ সালের নভেম্বর মাস। যুদ্ধ তখনও শুরু হয়নি, কিন্তু প্রস্তুতি ছিল শেষ পর্যায়ে। ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থা ও বিমানবাহিনীর মোট ১২০ জন শীর্ষ কর্মকর্তা একটি গোপন কনফারেন্সে একত্র হন। এই সভার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল: যুদ্ধে কারা মারা পড়বে, কোন স্থানগুলো গুঁড়িয়ে দেওয়া হবে তা নির্ধারণ করা।
এই সভার ফলাফল হয় এক বিশাল গুপ্তহত্যার তালিকা। ২৫০-র বেশি লক্ষ্যবস্তু চিহ্নিত করা হয়, যার মধ্যে ছিল:
শীর্ষ পারমাণবিক বিজ্ঞানী (যারা "অপারেশন নার্নিয়া"-র মূল লক্ষ্য),
গোপন পারমাণবিক স্থাপনা,
ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ কেন্দ্র,
ইরানের সামরিক কমান্ডার ও শীর্ষ অফিসারগণ।
এটিকে কেবল একটি "টার্গেট লিস্ট" বললে ভুল হবে—এ ছিল এক রণকৌশলগত ‘এক্সিকিউশন ম্যানুয়াল’। প্রতিটি নাম, প্রতিটি স্থানকে ঘিরে ছিল জ্যামিতিক সমন্বয়, আক্রমণের নির্ধারিত মুহূর্ত, এবং বিকল্প পরিকল্পনা।
ইসরায়েল জানত, কেবলমাত্র ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে পারমাণবিক প্রকল্প ধ্বংস করা যাবে না। যুদ্ধের সূচনাতেই প্রয়োজন ছিল আকাশ দখল। এ কারণে প্রথম দিকেই পরিকল্পনায় যুক্ত হয়—ইরানের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, রাডার ও মিসাইল লঞ্চারগুলোকে একযোগে ধ্বংস করতে হবে। এই উদ্দেশ্যে, ইসরায়েলি গোয়েন্দারা হাজার হাজার তথ্যসূত্র বিশ্লেষণ করে ইরানের বিমান প্রতিরক্ষা কাঠামোর পূর্ণ মানচিত্র তৈরি করে। এই মানচিত্রকে বলা যায় “এয়ার-ডিফেন্স কিল জোন চার্ট”।
ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ এই পর্যায়ে যুক্ত হয় মিশনে। তাদের দায়িত্ব ছিল: ভেতর থেকে আঘাত হানা। মোসাদের এজেন্টরা মাসের পর মাস ধরে ইরানে ছোট ছোট ড্রোনের অংশ চোরাইপথে সুটকেস, ট্রাক ও কনটেইনারের মাধ্যমে ঢোকায়। এগুলো ছিল এমনভাবে রিগ করা, যাতে বিস্ফোরক যুক্ত করে দূর থেকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এরপর, মোসাদের “স্লিপার টিম”-রা ওইসব ড্রোন নিয়ে ছড়িয়ে পড়ে ইরানের গুরুত্বপূর্ণ আকাশ প্রতিরক্ষা ও ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ স্থাপনাগুলোর আশেপাশে। এই ছোট টিমগুলোকে দেওয়া হয়েছিল নির্দিষ্ট সময়—ইসরায়েলি হামলা শুরু হওয়ার ঠিক পূর্বে, তারা নিজেরা স্বয়ংক্রিয়ভাবে ঐসব প্রতিরক্ষা ইউনিট ধ্বংস করে দেয়। এতে করে আকাশপথ হয় পুরোপুরি মুক্ত।
ইসরায়েল তার নিজস্ব ভূখণ্ড থেকেও অনেক বড় ড্রোন ব্যবহার করে হামলা চালায়। বিশেষ করে কিছু দীর্ঘপাল্লার ড্রোন, যেগুলোর রেঞ্জ ১,২০০ মাইল পর্যন্ত সেগুলোর প্রথম পরীক্ষামূলক ব্যবহার করা হয় হামলার ঠিক আগের রাতেই। এই ড্রোনগুলো ছিল AI সমন্বিত, উচ্চগতির এবং স্বনিয়ন্ত্রিত বিস্ফোরক বাহক যা নির্ধারিত সময়েই নির্ধারিত জায়গায় আঘাত হানতে সক্ষম।
২০২৫ সালের ৯ জুন, ইস্রায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ও তার সামরিক উপদেষ্টারা এক অতি-গোপন বৈঠকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেন: চার দিন পর, ১৩ জুন রাতে, ইরানে এক সমন্বিত আকাশ ও ড্রোন হামলা চালানো হবে। এই সিদ্ধান্ত ছিল একটি “point of no return” কারণ এর পরে পিছু হটার আর কোনো সুযোগ থাকবে না। ইসরায়েলি নিরাপত্তা সূত্র জানায়, এই সিদ্ধান্ত গোপন রাখতে হয়েছে অভূতপূর্ব যত্নে। কারণ, যদি ইরান আগে থেকে আঁচ করে ফেলে, তবে তারা তাদের পরমাণু বিজ্ঞানী ও সামরিক নেতৃত্বকে ছড়িয়ে দিতে পারত যা “অপারেশন নার্নিয়া” ও “রেড ওয়েডিং”-এর কার্যকারিতা ধ্বংস করে দিত। পরিকল্পনা গোপন রাখতে নেতানিয়াহু নিজের অফিস থেকে ঘোষণা দেন তিনি ছুটিতে যাচ্ছেন এবং তার বড় ছেলে অ্যাভনারের বিয়ে ১৬ জুন অনুষ্ঠিত হবে। ইসরায়েলি রাজনীতির জন্য এই খবর ছিল স্বাভাবিক, কেউই সন্দেহ করেনি। এমনকি অ্যাভনার বা নেতানিয়াহুর স্ত্রী সারাহ, কেউ জানত না যে এই বিয়েটিও ছিল “একটি সামরিক কভার”, যার পেছনে লুকানো ছিল ইতিহাসের সবচেয়ে সাহসী অভিযান। পরবর্তীতে নেতানিয়াহু স্বয়ং স্বীকার করেন, “আমার পরিবার কিছুই জানত না। এটা প্রয়োজন ছিল যেন শত্রুরা কিছু আঁচ না করে।”
যুদ্ধের ঠিক আগে ইসরায়েলি কর্মকর্তারা পরিকল্পিতভাবে সংবাদমাধ্যমে “ফাঁস” করেন যে নেতানিয়াহু ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যে ইরান নিয়ে মতবিরোধ চলছে। এই বিভ্রান্তিকর তথ্যের মধ্যে একটি ছিল: নেতানিয়াহু ও ট্রাম্পের মধ্যে ৯ জুন এক ফোনালাপ হয় যেখানে ট্রাম্প বলেন, “আমরা আগে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালাতে চাই।”
এই বক্তব্য ইরানি গোয়েন্দাদের মনে একটি বার্তা স্থাপন করে: “যুক্তরাষ্ট্র হামলার পক্ষে নয়, ফলে ইসরায়েল একা কিছু করবে না।” এটি ছিল পুরো ছলনার হৃদয়স্থল। একজন নিরাপত্তা কর্মকর্তা বলেন, “আমরা ইচ্ছাকৃতভাবে ইরানিদের মনে এই ধারণা গেঁথে দিয়েছিলাম যে, যদি আমেরিকা না নামে, ইসরায়েল হামলা করবে না।”
এই ধারণাটি এতটাই শক্তিশালী ছিল যে, হামলার দিনেও ট্রাম্প Truth Social-এ পোস্ট করেন:
“We remain committed to a Diplomatic Resolution to the Iran Nuclear Issue!”এমনকি মিডিয়ার সামনে বলেছিলেন: “আমরা ইরানের সাথে একটি চুক্তির খুব কাছাকাছি পৌঁছে গেছি।”
আশ্চর্যজনকভাবে, যখন বিশ্বের চোখ ছিল কূটনৈতিক আলাপ ও বিয়ের অনুষ্ঠানের দিকে, তখন ইসরায়েলের জেনারেলরা বাংকারে বসে ছিলেন হাতে টাইমলাইন, লিস্ট এবং অপারেশন ম্যাপ। জেটগুলো ফুয়েল নিচ্ছিল, ড্রোন রেঞ্জে যাচ্ছিল, আর মোসাদ-চালিত কোয়াডকপ্টারগুলো রেডি হয়ে যাচ্ছিল ইরানি আকাশ প্রতিরক্ষা গুড়িয়ে দেয়ার জন্য। সেনা সমাবেশ, বিমানঘাঁটি থেকে জঙ্গি বিমান ছেড়ে যাওয়া সবকিছুই প্রকাশ্যে করা হয়েছিল যাতে মনে হয় এটি নিছক মহড়া।
এই অভিযানের কেন্দ্রস্থলে ছিল অপারেশন, “রেড ওয়েডিং” যা ইরানের সামরিক বাহিনীর শীর্ষ নেতৃত্বকে একযোগে হত্যা করার অপারেশন। কৌশলটি ছিল সরাসরি ও মারাত্মক: নেতৃত্বহীন বাহিনী দ্রুত প্রতিশোধ নিতে পারবে না। যখন ইসরায়েলি যুদ্ধবিমান ইরানের আকাশসীমার দিকে অগ্রসর হচ্ছিল, তখন হঠাৎ জানা যায় ইরানি বিমানবাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তারা স্থান পরিবর্তন করছেন। এই খবর শুনে তেল আভিভের আন্ডারগ্রাউন্ড বাংকারে উপস্থিত ইসরায়েলি কমান্ডারদের মুখে আতঙ্ক ফুটে ওঠে।
সবার মনে একটিই প্রশ্ন: “তারা কি কিছু আঁচ করে ফেলেছে?”
কিন্তু পরম বিস্ময়ে দেখা যায়, ইরানি বিমানবাহিনীর নেতারা ভাগে ভাগে পালিয়ে যাওয়ার পরিবর্তে একসাথে একটি স্থানে জমায়েত হয়েছেন সম্ভবত জরুরি প্রতিরক্ষা পরিকল্পনার জন্য। তাদের এই সিদ্ধান্তই হয় মৃত্যু অনিবার্য করে তোলে। ঠিক সেই মুহূর্তে ইসরায়েলি মিসাইলগুলো আকাশ ছিন্ন করে ঝাঁপিয়ে পড়ে। মুহূর্তের মধ্যে এবং তাদের মৃত্যু হয়। একই সময়ে ইসরায়েলি ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্রগুলো লক্ষ্য করে ইরানের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে থাকা পারমাণবিক বিজ্ঞানীদের বাসা। “অপারেশন নার্নিয়া”-র সফল বাস্তবায়নে, ৯ জন শীর্ষ বিজ্ঞানী একযোগে নিহত হন। মাত্র চার ঘণ্টা সময় লেগেছিল এই সম্পূর্ণ আক্রমণের প্রথম ধাপ শেষ করতে। এক দশকেরও বেশি পরিকল্পনা, শত শত গোয়েন্দা ও প্রযুক্তি ব্যয়, আর এক অপূর্ব সমন্বয়ের মাধ্যমে ইসরায়েল ইরানের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার মেরুদণ্ড ভেঙে দেয়। এর পরের দিনগুলোতে ইসরায়েলি বিমান একের পর এক আঘাত হানে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনা, ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র উৎপাদন কেন্দ্র ও কমান্ড পোস্টে। একই সঙ্গে চলতে থাকে বিজ্ঞানী ও সামরিক নেতাদের অনুসন্ধান ও টার্গেটেড কিলিং। ভবিষ্যতে সামরিক ইতিহাসে ইস্রায়েলের এই হামলা একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে।
0 Comments