সেকেন্ড টেম্পল বা দ্বিতীয় মন্দির ধ্বংস ইহুদি ইতিহাসে একটি গুরত্বপূর্ণ সময়। মন্দির ছিল ইহুদি ধর্মীয় জীবনের কেন্দ্রবিন্দু। মন্দির ধ্বংসের ফলে ইহুদি জনগণ ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিকভাবে এক গভীর সংকটের মধ্যে পড়ে। এই সময় থেকে ইহুদিরা তাদের নিজ নিজ ভূখণ্ড থেকে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। এই বিচ্ছিন্নতা ইহুদি ধর্মের কেন্দ্রীকরণ থেকে বিচ্ছিন্নতার সময় বলে গণ্য। যদিও ইহুদিরা পুরোপুরি একটি ঐক্যবদ্ধ জাতি হিসেবে থেকে যায়, কিন্তু তাদের রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক কেন্দ্রবিন্দু পরিবর্তিত হয়। আর মন্দিরের বদলে টেলিম (Torah) এবং রাব্বানিক জ্ঞান ও আইন পণ্ডিতদের নেতৃত্বে ইহুদি ধর্মীয় জীবন পরিচালিত হতে শুরু করে।
১১৫ থেকে ১১৭ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে রোমান সাম্রাজ্যের পূর্বাঞ্চলীয় বিভিন্ন প্রদেশে বিচ্ছিন্ন ইহুদি সম্প্রদায় আবারও ব্যাপক বিদ্রোহে শুরু করে। এই বিদ্রোহের পেছনে কাজ করেছিল, তাদের মেসিয়াহর জন্য অপেক্ষ আর নির্বাসিত ইহুদিদের ফেরত আসার ও দ্বিতীয় মন্দির পুনর্নির্মাণের আকাঙ্ক্ষা । এই আন্দোলন সম্ভবত একটি বৃহত্তর প্রতিরোধের সূচনা হিসেবে দেখা যেত, যার লক্ষ্য ছিল যুদিয়া ফেরত যাওয়া এবং যেরুজালেম পুনর্নির্মাণ। কিন্ত রোমনরা অত্যন্ত নৃশংস কায়দায় এই বিদ্রোহ দমন করে। ১৩২ থেকে ১৩৬ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত জুডেয়ার ইহুদি নেতা বার সিমন কোকবা বিদ্রোহের কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন। এই বিদ্রোহ হাদ্রিয়ান সম্রাটের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠে, যিনি যেরুজালেম ধ্বংসপ্রাপ্ত স্থানের উপর পাগান উপনিবেশ ‘এলিয়া ক্যাপিটোলিনা’ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছিলেন। সিমন বার কোকবা নেতৃত্বাধীন এই বিদ্রোহী ইহুদিরা স্বল্পকালীন একটি রাষ্ট্র গড়ে তোলে, যেখানে বার কোকবাকে ‘নাসি’ বা ইস্রায়েলের ‘প্রিন্স’ হিসেবে অভিহিত করা হয়।এই বিদ্রোহী রাষ্ট্র তাদের মুদ্রায় “ইস্রায়েলের স্বাধীনতা” এবং “যেরুজালেমের স্বাধীনতার জন্য” জাতীয়তাবাদী স্লোগান ব্যবহার করেছিল। তবে রোমানরা দ্রুত ছয়টি লেজিয়ন ও অতিরিক্ত বাহিনী নিয়ে আসেন, এবং জুলিয়াস সেভেরাসের নেতৃত্বে এই বিদ্রোহ কঠোরভাবে দমন করা হয়। ঐতিহাসিক সূত্র অনুসারে ৫০টি গুরুত্বপূর্ণ দুর্গ ও ৯৮৫টি গ্রাম ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। প্রায় ৫৮০,০০০ ইহুদি নিহত হন, এবং অঞ্চল জুড়ে দুর্ভিক্ষ ও রোগব্যাধি ছড়িয়ে পড়ে।
রোমান সাম্রাজ্যের সঙ্গে ইহুদি জনগণের সম্পর্ক ’দেরী’ রোমান যুগেও জটিল ছিল। সম্রাট কনস্ট্যান্টাইন প্রথম (৩২৭-৩৭০ খ্রিষ্টাব্দ) ইহুদি জনগণকে বছরে একবার তিসা ব'আভ (Tisha B'Av) দিন পশ্চিমের প্রাচীর (ওয়েস্টার্ন ওয়াল) এ তাদের পরাজয় স্মরণ করার অনুমতি দেন। ৩৫১-৩৫২ খ্রিষ্টাব্দে গালিলিতে ইহুদিরা আবারও একটি বিদ্রোহ চালায়, যা রোমানদের কঠোর দমন ও প্রতিশোধের মুখে পড়ে। ৩৫৫ খ্রিষ্টাব্দে সম্রাট জুলিয়ান (অর্থাৎ জুলিয়ান দ্য অ্যাপোস্টেট), যিনি খ্রিস্টধর্মের বিরোধী ছিলেন, ইহুদিদের পুনরায় মন্দির নির্মাণের অনুমতি দেন। তবে ৩৬৩ খ্রিষ্টাব্দে গালিলি ভূমিকম্প এবং অন্যান্য কারনে মন্দির পুনর্নির্মাণ ব্যর্থ হয়। পরে জুলিয়ান পারসিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে মারা যাওয়ার ফলে ইহুদি স্বপ্নগুলো শেষ হয়ে যায় এবং বাইজেন্টাইন শাসনামলে খ্রিস্টান শাসকরা ইহুদিদের ওপর আরও কঠোর হয়। ৪৩৮ খ্রিষ্টাব্দে সম্রাজ্ঞী ইউডোসিয়া যখন ইহুদিদের মন্দিরের স্থানে প্রার্থনার নিষেধাজ্ঞা তুলে দেন, তখন গালিলির ইহুদি নেতারা বিশ্বাস করেছিল নির্বাসনের অবসান হয়েছে। কিন্তু খ্রিস্টানরা এই সিদ্ধান্তে বাধা দেয় এবং ইহুদিদের শহর থেকে বের করে দেয়। ৭ম শতাব্দীর শুরুতে ইহুদিরা পারস্যদের সঙ্গে জোট গড়ে এবং ৬১৪ খ্রিষ্টাব্দে তারা বাইজেন্টাইনদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। পারস্য-ইহুদি বাহিনী যেরুজালেম দখল করে অস্থায়ী স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠা করে। কিন্তু খ্রিস্টান বিদ্রোহ ও হত্যাকাণ্ডের ফলে এই স্বায়ত্তশাসন খুব অল্প সময় স্থায়ী হয়।
পারস্য বাহিনী প্রত্যাহার করলে ইহুদিরা বাইজেন্টাইনদের কাছে আত্মসমর্পণ করে, কিন্তু ৬২৯ খ্রিষ্টাব্দে খ্রিস্টান উগ্রপন্থীদের হাতে অনেক ইহুদি নিহত হয় এবং বাকি দল পালিয়ে মিশরে আশ্রয় নেয়। পরিশেষে ৬৩৭ খ্রিষ্টাব্দে মুসলিম আরব বাহিনী অঞ্চল দখল করে বাইজেন্টাইন শাসন শেষ করে।
মুসলিমরা আসার পর বহু বছর পর ইহুদি জাতি অত্যাচার থেকে মু্ক্তি পায়। ইসলাম রাজনৈতিকভাবে নতুন এক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে, যা ইহুদি অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং জ্ঞানগত বিকাশের জন্য এক নতুন অধ্যায় রচনা করে। খলীফা উমর ইহুদিদের জেরুজালেমে পুনরায় বসবাস করার অনুমতি দেন, যা ছিল প্রায় ৫০০ বছর পর তাদের ফিরে আসা। ইহুদি ঐতিহ্য অনুযায়ী, খলীফা উমর ছিলেন এক সদয় শাসক এবং ‘মিদরাশ’ (নিস্তারোত দে-রব শিমোন বার ইয়োচাই) তাকে “ইসরায়েলের বন্ধু” বলে আখ্যায়িত করে। আরব ভূগোলবিদ আল-মুকাদ্দাসি লিখেছেন, তৎকালীন সমাজে ইহুদিরা মুদ্রা নিরীক্ষক, রংমিস্ত্রি, ট্যানারি এবং ব্যাংকার হিসেবে কাজ করতেন। ফাতেমীয় শাসনামলেও বহু ইহুদি কর্মকর্তা প্রশাসনে গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন। ঐতিহাসিক মোশে গিলের মতে, ৭ম শতকের আরব বিজয়ের সময় ফিলিস্তিন ও আশপাশের অঞ্চলের জনসংখ্যার একটি বড় অংশই ছিল খ্রিষ্টান ও ইহুদি। ৭ম শতকে মুসলিম শাসকেরা খারাজ (ভূমি কর) চালু করলে বহু ইহুদি গ্রাম ছেড়ে শহরে, বিশেষ করে বাগদাদে স্থানান্তরিত হয়। এর ফলে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, বাণিজ্যিক প্রভাব এবং জ্ঞানচর্চার প্রসার ঘটে। এই সময়েই প্রখ্যাত ইহুদি চিন্তাবিদ সাঅদিয়া গাওন গ্রিক ও ইসলামী দর্শনের সঙ্গে ইহুদি চিন্তার সমন্বয় সাধনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ১০ম শতকে আব্বাসীয় খেলাফত ও বাগদাদের প্রভাব কমে গেলে অনেক ইহুদি ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে অভিবাসন করেন এবং ব্যাবিলোনীয় ইহুদি রীতিনীতির বিস্তার ঘটান।
তবে ১১শ শতকে ক্রুসেড শুরু হলে ইহুদিদের জীবনে আবারও অন্ধকার নেমে আসে। ইহুদি ইতিহাসবিদ রাব্বি শলোমো বেন শিমশনের বিবরণ অনুযায়ী, ক্রুসেডাররা পবিত্র ভূমিতে যাওয়ার পথে সিদ্ধান্ত নেয় যে, “ইসমায়েলদের (মুসলিমদের) বিরুদ্ধে যুদ্ধে যাওয়ার আগে, তাদের মাঝখানে বসবাসকারী ইহুদিদের হত্যা করেই যিশুর প্রতিশোধ নেওয়া উচিত।” এই হত্যাযজ্ঞ শুরু হয় ফ্রান্সের রুয়ান শহর থেকে এবং রাইন নদী উপত্যকার ইহুদি সম্প্রদায় ভয়াবহ আক্রমণের শিকার হয়। ১০৯৯ সালে ক্রুসেডার বাহিনী জেরুজালেম আক্রমণ করে। ইহুদিরা মুসলিমদের সঙ্গে মিলে শহর রক্ষার চেষ্টা করে। শহর পতনের পর বহু ইহুদিকে একত্র করে একটি সিনাগগে আটকে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। হাইফা শহরে প্রায় এক মাস (জুন–জুলাই ১০৯৯) ইহুদিরা একক প্রচেষ্টায় ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যায়। এই সময় ফিলিস্তিনে জেরুজালেম, তিবেরিয়াস, রামলাহ, আশকেলন, কাইসারিয়া ও গাজাসহ বহু স্থানে ইহুদি সম্প্রদায় ছড়িয়ে ছিল।
পরবর্তীতে মামলূক সালতানাতের সময়টা তারা নির্বিঘ্নে পার করে। ইউরোপের বড় অংশ জুড়েও ছিল তাদের বসবাস। বিশেষ করে স্পেন, ফ্রান্স আর পর্তুগালে অনেক ইহুদি স্থায়ীভাবে বাস করতে শুরু করে।
১৩৯১ সালে স্পেনজুড়ে ঘটে এক ভয়াবহ পোগ্রোম (ধর্মীয় ঘৃণাজনিত দাঙ্গা), যেখানে ইহুদিদের গণহারে হত্যা ও ধর্মান্তরিত করা হয়। এই হামলায় নিহত বা ধর্মান্তরিত হওয়া ইহুদির সংখ্যা ছিল বিপুল, প্রায় ৩,০০,০০০ জন ইহুদির একটি বৃহৎ অংশ ক্যাথলিক খ্রিস্টধর্ম গ্রহণে বাধ্য হয়। এদের অনেকেই সত্যিকার অর্থে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেননি; বরং নিরাপত্তার স্বার্থে বাহ্যিকভাবে ধর্ম পরিবর্তন করে গোপনে ইহুদি আচার-অনুষ্ঠান পালন করতে থাকেন। এদের ‘কনভার্সো’ (Converso) বা ‘মারানো’ বলা হতো। ১৪৯২ সালে স্পেনের মুসলিম রাজ্য গ্রানাডা বিজয়ের পর ক্যাথলিক রাজা ও রানি (ফার্দিনান্দ ও ইসাবেলা) আলহাম্ব্রা ফরমান জারি করেন। এতে স্পেনের অবশিষ্ট ১,০০,০০০ ইহুদিকে মাত্র দুটি বিকল্প দেওয়া হয়: খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ অথবা দেশত্যাগ। এই ফরমান অনুযায়ী প্রায় ৫০,০০০ থেকে ৭০,০০০ ইহুদি স্পেন ত্যাগ করেন। বাকিরা কনভার্সো সম্প্রদায়ের সঙ্গে মিশে যান। যারা বাহ্যিকভাবে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে অনেকেই গোপনে ইহুদি ধর্ম পালন করতেন। এই কারণে ৪০ বছর ধরে (বিশেষ করে ১৫৩০ সালের আগ পর্যন্ত) স্প্যানিশ ইনকুইজিশন কনভার্সোদের বিরুদ্ধে নির্মম নির্যাতন চালায়। এ সময় গোপনে ইহুদি রীতি পালনের অভিযোগে বহু মানুষকে জীবন্ত আগুনে পুড়িয়ে মারা হয়। ফলে ইহুদিরা আবারও বাস্তুচ্যুত হয়।
এরপর আবারও তাদের আশ্রয় দেয় মুসলিমরা। তাদের জায়্গা হয় ওসমানী সাম্রাজ্যে।
১৭শ শতকে পশ্চিম ও মধ্য ইউরোপে উল্লেখযোগ্য ইহুদি জনসংখ্যা গড়ে উঠেছিল। বিশেষভাবে পোল্যান্ড ছিল ইউরোপের সর্ববৃহৎ ইহুদি জনবসতির কেন্দ্র, যার সূচনা ১৩শ শতকে হয়েছিল। পোল্যান্ড-লিথুয়ানিয়া কমনওয়েলথে ইহুদিরা প্রায় চারশো বছর ধরে তুলনামূলক শান্তি ও স্বাধীনতা ভোগ করেছিল। তারা ব্যবসা, ধর্মীয় শিক্ষা, এবং সংস্কৃতিতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিল। তবে এই শান্তিপূর্ণ অবস্থার অবসান ঘটে ১৬৪৮ সালে ইউক্রেনীয় কসাকদের দ্বারা সংঘটিত খমেলনিতস্কি বিদ্রোহ এবং ১৬৫৫ সালে সুইডিশ যুদ্ধ চলাকালে। এই সহিংসতায় পোল্যান্ড ও লিথুয়ানিয়ার লক্ষাধিক ইহুদি হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের শিকার হন। ইতিহাসবিদদের মতে, এই সময় ইহুদি জনগোষ্ঠীর উপর পরিচালিত গণহত্যা ছিল ইউরোপে ঘটে যাওয়া সবচেয়ে ভয়াবহ ইহুদি নিধনের একটি। এই পরিস্থিতি থেকে বাঁচতে অনেক ইহুদি পশ্চিম ইউরোপে, বিশেষত আমস্টারডামে চলে যান। ১৬৫৪ সালে ইউরোপে ইহুদিদের বসবাসের ওপর সর্বশেষ নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হলেও বিভিন্ন শহর থেকে সময় সময় ইহুদিদের বিতাড়ন অব্যাহত ছিল। তাছাড়া, ইহুদিদের ভূমির মালিকানা পেতে নিষেধাজ্ঞা ও ঘেটোতে বসবাসের বাধ্যবাধকতা তখনও বহাল ছিল। ১৮শ শতকের শেষ দিকে পোল্যান্ডের বিভাজন ঘটলে দেশটি রাশিয়ান সাম্রাজ্য, অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্য ও প্রুশিয়ার মধ্যে বিভক্ত হয়ে যায়। এর ফলে বৃহৎ পোলিশ-ইহুদি জনগোষ্ঠী তিনটি সাম্রাজ্যের অধীনে চলে যায়। এই বিভাজন ইহুদিদের রাজনৈতিক অবস্থান ও সামাজিক নিরাপত্তার উপর গভীর প্রভাব ফেলে এবং তাদের পরবর্তী ইতিহাসকে গঠনে ভূমিকা রাখে। এরপর শুরু হয় জায়োনিস্ট আনে্দালন, যা থেকে পরবর্তীতে প্রতিষ্টা করা হয় ইজরায়েল রাষ্ট্র। যা আজকের বিশ্বকেও করেছে অশান্ত। তাই পরের পর্বে থাকছে সেই গল্প।
0 Comments